SkillBox HelpBD

Hot

Post Top Ad

Post Top Ad

Wednesday, December 14, 2016

আয়নাবাজির কাহিনী সার-সংক্ষেপ -এমএসএস রেহমান

Wednesday, December 14, 2016 0
                                                    


                                                    আয়নাবাজির কাহিনী
আয়নাবাজি একমাত্র চলচ্চিত্র, যেটি অন্তত দুবার দেখব বলে মুক্তির আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। দর্শক হিশেবে আমি অত্যন্ত ছিদ্রান্বেষী খুঁতখুঁতে। ছবির দুর্বল সবল দিকগুলোর কোনোটি যেন রিভিউতে বাদ না যায়, সেজন্য আমি প্রেক্ষাগৃহে কাগজ-কলম নিয়ে যাই। আয়নাবাজি প্রথমবার দেখেছিলাম মুক্তির দিনই। চলচ্চিত্র সবান্ধব দেখলে হাসি-তামাশার দাপটে ত্রুটিগুলো চোখে কম পড়ে। প্রথম দর্শনে আয়নাবাজিকে নিশ্ছিদ্র মনে হওয়ায় পণ করেছিলাম একা-একা দ্বিতীয়বার দেখে কোনো-না-কোনো ছিদ্র আবিষ্কার করবই এবং গতকাল একা-একা দেখে ছিদ্র-আবিষ্কারে ফের শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলাম। আমার এই ব্যর্থতা চৌধুরী বংশের পুত্র অমিতাভ রেজার বিজয় এবং তার এই বিজয় কোনো রাজনৈতিক চক্রান্ত নয়, নয় স্থূল বা সূক্ষ্ম কারচুপি; তার বিজয়টি একজন মানবের অতিমানবিক সতর্কতার ফসল।
যে দণ্ডবিধির অধীনে আমাদের দেশে বিচার-আচার হয়, আদিতে সেটির নাম ছিল ইন্ডিয়ান পেনাল কোড দেশবিভাগের পর সেটি পাকিস্তান পেনাল কোড নাম ধারণ করলেও স্বাধীনতার পর সেটি বাংলাদেশ পেনাল কোড নাম ধারণ করেনি; সেটির নাম হয়ে গেছে কেবল পেনাল কোড, বাংলায়দণ্ডবিধি আমাদের চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা মোতাবেক আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো বলে একটি বহুল উচ্চারিত বাক্য থাকলেও আদতে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি বলে কোনো আইনের অস্তিত্ব নেই। আয়নাবাজিতে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি পরিবর্তে দণ্ডবিধি টার্মটি ব্যবহৃত হতে দেখেই বুঝে নিয়েছি ছবিটির পেছনে অমিতাভ রেজা ব্যাপক শ্রম দিয়েছেন, ব্যাপক কাঠখড় পুড়িয়েছেন ছবিটির অথেন্টিসিটি রক্ষার পেছনে। ছবিটি নির্মাণের পেছনের গল্প নিয়ে স্বপ্রণোদিত Amitabh গতরাতে আধঘণ্টার টেলিসংলাপে যে বয়ান অামাকে দিয়েছেন, তা থেকে জানলাম ছবিটিতে যে রায়গুলো পাঠ করা হয়েছে, তা তিনি একজন আসল বিচারককে দিয়ে লিখিয়েছেন এবং আদালতের দৃশ্যগুলো ধারণকালে তিনি সাথে রেখেছিলেন একজন পেশাদার আইনজীবীকে!
প্রচলিত বাংলা ছায়াছবিতে আদালত বা কারাগারের যে দৃশ্যাবলি আমরা দেখি, তা অবাস্তব। অমিতাভ আয়নাবাজি শুট করেছেন আসল কারাগারে কাশিমপুরে আর কেরানিগঞ্জে। কেরানিগঞ্জের কারাগারে তিনি ইচ্ছেমতো শুট করার সুযোগ পেয়েছেন, তখনও কারাগারটি উদ্বোধন করা হয়নি বলে। দিক দিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান। গোটা ছবিতে চঞ্চলের পরিহিত কয়েদির পোশাকে কোমরে বেল্ট দেখা যায় মোটে একবার, শেষ ঘটনাটিতে অভিযুক্ত হওয়ার পরে অভিযুক্ত হওয়ার আগে কয়েদির পোশাকে বেল্ট থাকে না পরিচালক এই ব্যাপারটিও কীভাবে মাথায় রেখেছেন, ভাবতেই মাথায় পাক দেয়।
কারাগারে আমদানিঘর বলে একটা মিলনায়তন থাকে, নবাগত আসামিদেরকে দিন দুয়েক ওখানে রাখা হয়। বলা যায় ওখানে তাদের ওরিয়েন্টেশন বা নবীনবরণ হয়। প্রথম বর্ষের ছাত্রদেরকে হলের গেস্টরুমে অগ্রজরা যেভাবে বয়ান দেয়, অগ্রজ আসামিরা নবাগতদের আমদানিঘরে ওভাবে বয়ান দেয়। আমদানিঘরে যে পরিপাটি চঞ্চলকে দেখানো হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত না হলেও আমদানিঘরে অন্য যে দৃশ্যাবলি দেখানো হয়েছে, তা জেলসম্মত। কারাগারের দৃশ্যপট অনুধাবনের জন্য অমিতাভ ছয়টি মাস বিভিন্ন কারাগারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। চমকপ্রদ যে ব্যাপারটি অমিতাভ আমাকে বলেছেন, সেটি হচ্ছে এই আয়নাবাজিতেই এমন একজন অভিনেতা আছেন, যিনি বাস্তবে জেল খেটেছেন। সেই অভিনেতাটি কে তা জানার জন্য আমি পীড়াপীড়ি করিনি।
বিচারব্যবস্থা ভয়াবহ রকমের ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে, মামলাজট কারাগারে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কয়েদির কারণে বাংলাদেশের কারাগারে অনিয়ম হচ্ছে। মাত্রই কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে পড়েছি রামপুরার এক খুনির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও কারাগারে থাকাবস্থায়ই সে বাবা হয়েছে। তাকে একবার কারাগারে ঢোকানো হলেও গুনতি মিলিয়ে দিয়ে ভাড়ার বিনিময়ে হয়তো জেল খেটেছে অন্য কেউ, আর খুনি গোপনে পয়দা করে গেছে একের পর এক বাচ্চা। গাউসুল আজম শাওনের আয়নাবাজি গল্পটিকে যারা অবাস্তব মনে করেছেন, তারা ভুল করছেন; গল্পটি তিনি পত্রিকার সংবাদ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন।
অমিতাভ আমাকে জানালেন রাজনীতিকরূপী চঞ্চল গ্রেপ্তার হওয়ার পর টিভিতে যে খবরটি প্রচারিত হয়, সেখানে তিনি আরটিভির এক পেশাদার সংবাদপাঠিকাকে ব্যবহার করেছেন; জর্জ যে ডিজে পার্টিটিতে গিয়েছিলেন, সেখানে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য অমিতাভ ব্যবহার করেছেন পেশাদার ডিসকো জকি রাহাতকে, যেখানে তিনি নিজে কণ্ঠ দিলেও পারতেন। অর্থাৎ অকৃত্রিমতার সাথে একচুল আপস করেননি অমিতাভ রেজা।
চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম এক দশক আগে শিল্পকলা অ্যাকাডেমির মঞ্চে, চের সাইকেল নাটকে। নাটকটিতে অনেকগুলো চরিত্র থাকলেও মাত্র তিনজন অভিনেতা-অভিনেত্
রী (চঞ্চল, মামুনুর রশিদ রুবলি) মুহূর্তের মধ্যে পোশাক কণ্ঠ বদলে চরিত্রগুলো চিত্রায়ণ করেছিলেন। চঞ্চলের এক দশক আগের সেই ঘোরলাগা অভিনয় এখনও চোখে লেগে আছে বলে আয়নাবাজিতে অর্ধডজন চরিত্রে তার অভিনব অভিনয়ে নতুন করে চমৎকৃত হইনি। চাঞ্চল্যকর চরিত্রগুলোকে চঞ্চল যেভাবে সামাল দিয়েছেন, তা তাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই প্রজন্মের গল্পের খোরাকে পরিণত করে ফেলবে আমার বিশ্বাস।
মাসুমা রহমান নাবিলা উপস্থাপনা করেন বা করতেন বলে শুনেছি, এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আগে তাকে চিনতাম না। তাকে প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছে এতদিন কোথায় ছিলেন! অবশ্যবেটার লেট দ্যান নেভার প্রবাদটা মনে করে সান্ত্বনা খুঁজেছি। নাবিলার পরিমিত হাসি, হাঁসের ডিমের মতো চোখ, চঞ্চলের জন্য চাঞ্চল্য, প্রেমিককে উৎফুল্ল উদ্বাহু চুম্বন দর্শকহৃদয়ে যেমন দোলা দিয়েছে; দর্শককে তেমনি শোকাহত করেছে রেল স্টেশনে প্রেমিকের অনুপস্থিতি দেখে নাবিলার উৎসুক উদ্ভিন্ন চোখ, পিতার মৃত্যুতে তার বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মুখ। পিতার মৃত্যুর পর কন্যার মুখাভিব্যক্তি যেমন থাকার কথা, পরিচালকের মুনশিয়ানায় নাবিলার মুখাভিব্যক্তি ঠিক তেমনই ছিল। তবে চঞ্চলকে নাবিলার চুমু খাওয়ার দৃশ্যে চঞ্চলের হাত যথাস্থানে ছিল বলে মনে করি না, চুম্বনকালে প্রেমিকের হাত কোন অবস্থানে থাকার কথা তা পরিচালকের ভালো জানার কথা। যা হোক, নাবিলা আর যদি অভিনয় না- করেন, আয়নাবাজির হৃদি হিশেবে দীর্ঘদিন তাকে মনে রাখতেই হবে। এমন নয়নাভিরাম নারীকে ভুলে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
লুৎফর রহমান জর্জকে প্রথম দেখেছিলাম কোথাও কেউ নেই নাটকে একটি অপ্রধান চরিত্রে, বাকের ভাইয়ের শাগরেদ (মজনু) হিশেবে। ৪২০ নাটকে Mostofa Sarwar Farooki তাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। দীর্ঘ ধারাবাহিকে জর্জ তার জাত চিনিয়েছিলেন, আয়নাবাজিতে ক্ষুদ্রতর একটি চরিত্রেও তিনি দুরন্ত অভিনয় করেছেন। সদা কুঁচকিপূজা-রত জর্জের মুখে উচ্চারিত বাঘতত্ত্ব দর্শককে আদিরসে সিক্ত করেছে।
প্রিয় গায়ক পার্থ বড়ুয়া দীর্ঘদিন ধরে অভিনয় করলেও এর আগে তার অভিনয় দেখা হয়নি। তার চেহারা যদি চেনা না থাকত, তা হলে আয়নাবাজিতে তার অভিনয় দেখে বুঝতেই পারতাম না তিনি পূর্ণকালীন অভিনয়শিল্পী নন। বসে-তাড়ানো বউয়ে-খেদানো মদ্যাসক্ত সাংবাদিকের চরিত্রে যে অভিনয়টা তিনি করেছেন, তাতে মনেই হয়নি তিনি সাংবাদিক নন। পার্থর সাবেক স্ত্রীর চরিত্রে কয়েক সেকেন্ডের জন্য পর্দায় উপস্থিত হয়ে বিজরী বরকতউল্লাহ প্রমাণ করে দিলেন তিনি বড় হচ্ছেন, বেড়ে উঠছেন; কিন্তু কখনও তিনি বুড়ো হবেন না।
বিজ্ঞাপননির্মাণ প্রতিষ্ঠান গ্রের কর্ণধার Gousul Alam Shaon বহুদিন ধরে অভিনয় করলেও তাকে পর্দায় প্রথম দেখেছি গ্রামীণফোনের আমরা আমরাই তো শিরোনামের একটি বিজ্ঞাপনে। ফের দেখলাম আয়নাবাজিতে স্টুডিয়ো-মালিক চরিত্রে। অট্টহাসি হাসার সময়ে যেভাবে তার দেহের গোশত নাচে কিংবা তিনি যেভাবে গোশত নাচান, তা চমকপ্রদ। পার্থকে চঞ্চল-জর্জের ছবি তোলা থেকে বিরত রাখতে গিয়ে যে চাতুর্যপূর্ণ অভিনয়টি তিনি দেখিয়েছেন, তাও মনে রাখার মতো। তিনি ছবিটির অন্যতম প্রযোজকও বটে। সবচেয়ে বড় কথা যে গল্পের কারণে আয়নাবাজি এত আলোচিত, যে গল্পটি নিয়ে আমাদের এত মাতামাতি; সেটি শাওনেরই রচিত। পরিচালনার কারণে ছবিটি যতটা অমিতাভের, রচনা-প্রযোজনা-অভিনয়ের কারণে ততটা শাওনেরও।
জর্জ-চঞ্চলের যৌথ ছবি তোলার সময়ে দাড়িধারী ছদ্মবেশী গাউসুলের সাথে বোরকাধারী যে নারীটি পার্থকে বাধা দেয়, সেই নারীটি হচ্ছে ক্লিনিকে পার্থকে ধমক-দেওয়া সেই উচ্চকণ্ঠী রিসিপশনিস্টটি এটি অনেকের মতো আমিও ছবিটি একাধিকবার দেখেও বুঝিনি, অমিতাভ সেটি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে আরো বুঝিয়েছেন আয়নার বিবর্তনতত্ত্ব। মানুষের মূল মূলত মা মাটির মধ্যে প্রোথিত। ছবির প্রথমেই মায়ের মৃতদেহ দেখিয়ে গল্পকার আয়নাকে প্রথমত মাতৃহীন করেছেন, কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এনে আয়নাকে গল্পকার মাটিছাড়া করেছেন। মা মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল মানুষেরা বাঁচার জন্য সব করতে পারে, যেমনটা করেছে আয়না; জীবনে হৃদির (নাবিলা) আগমনের পর আয়না ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছে, কারণ হৃদির ভেতরে প্রেমিকারূপের পাশাপাশি সে মাতৃরূপও দেখেছে। পরিচালক অমিতাভের কাছ থেকে এই ব্যাখ্যা পাওয়ার পর ছবিটা তৃতীয়বার দেখতে ইচ্ছে করছে!
আয়নাবাজি চলচ্চিত্রের প্রাণ প্রথমত এর গল্প, দ্বিতীয়ত এর গান। ফুয়াদের সংগীতায়োজনে ছবির শিরোনামগানটি চমৎকার হলেও চার-ছক্কা হইহই, বল গড়াইয়া গেল কই গানের সুর থেকে তিনি এখনও বেরিয়ে আসতে পারেননি। আর শারমিন সুলতানা সুমি আমার কী দোষ, খালি পাপ জমাই গানটি লেখার কারণে পরবর্তী বছর শ্রেষ্ঠ গীতিকার গাওয়ার কারণে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিশেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলে অবাক হব। বহুদিন পর এমন গতিময় কোনো আধ্যাত্মিক গান শুনলাম; একবার না, বাজিয়ে-বাজিয়ে সিকি শতবার শুনলাম।
এই ছিদ্রান্বেষী আমি অনেক খুঁজেও ছবিটিতে কোনো ছিদ্র আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হওয়ার পর অমিতাভ আমি নিজেই আপনাকে কিছু ছিদ্র বের করে দিচ্ছি বলে আমাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার আবিষ্কৃত ছিদ্রগুলোকে দর্শক হিশেবে আমার কাছে ছিদ্র বলে মনে হয়নি, বরং ছিদ্র বের করে দিয়ে আমাকে তার সহযোগিতা করার চেষ্টাটাকেই একটা ছিদ্র বলে মনে হলো!
অতি-সতর্ক দৃষ্টি বোঝাতে এতদিন শকুনের চোখ বলে একটি বাগধারা এই বঙ্গীয় জনপদে প্রচলিত ছিল। আমি ক্ষমতায় গেলে এটি বদলে অমিতাভের চোখ বলে নতুন বাগধারার প্রবর্তন করব বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। পরিশেষে বলি আয়নাবাজি একটি অরাজনৈতিক চক্রান্ত।
পরিশেষে আয়নাবাজির ট্রেলার দেখার অনুরোধ জানিয়ে শেষ করছি...




        

                                                   আয়নাবাজি
Read More

Post Top Ad